শাহবাগের
প্রজন্ম চত্বর জেগে থাকবে। প্রবল প্রতিবাদের মুখে বাতিল করা হয়েছে বেলা
তিনটা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কর্মসূচি। একজন ব্লগার
হত্যা এবং জামায়াতের ডাকা হরতালের প্রতিবাদে রাত ১১টার দিকে আগের কর্মসূচি
বাতিল করা হয়। এর ফলে এখন থেকে গত ১১ দিনের মতোই টানা আন্দোলন চলবে।
এর আগে গতকাল শুক্রবার মহাসমাবেশ থেকে সাত ঘণ্টা অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। তবে এই ঘোষণা অনেকেই মানতে পারেননি। ব্লগসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে এ নিয়ে লেখালেখি শুরু হয়। শাহবাগে অবস্থানরতরাও প্রতিবাদ জানাতে থাকেন। তবে প্রতিবাদ তীব্র হয় রাত ১০টার পর। এ সময় খবর ছড়িয়ে পড়ে, আহমেদ রাজীব হায়দার নামের একজন ব্লগারের মৃতদেহ পাওয়া গেছে মিরপুরে। তিনি শাহবাগ আন্দোলনের একজন সক্রিয় সমর্থক ছিলেন। তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
ব্লগার হত্যার সংবাদটি ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ২০ থেকে ৩০ হাজার মানুষ আগে থেকেই শাহবাগ ছেড়ে না যাওয়ার জন্য অবস্থান করছিলেন। তাঁরা মিছিল বের করেন। গণজাগরণ মঞ্চ দখল করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়।
এ পর্যায়ে ১১টার দিকে মঞ্চে আসেন ব্লগার অ্যান্ড অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট নেটওয়ার্কের আহ্বায়ক ইমরান এইচ সরকার। তিনি এসে অবস্থান কর্মসূচি অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন।
মঞ্চ থেকে ১১টা ২৩ মিনিটে ব্লগার রাজীবের মৃত্যুতে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। মঞ্চ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়, জামায়াত-শিবির একজন ব্লগারকে খুন করেছে। এ ছাড়া তারা হরতাল ডাকার মতো দুঃসাহস দেখাচ্ছে। এ অবস্থায় কেবল মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের ফাঁসিই নয়, জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি জানানো হয়। এই দুই দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত কেউ ঘরে ফিরবেন না বলেও মঞ্চ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়।
জানা গেছে, ব্লগার রাজীবকে নিয়ে (ব্লগে তিনি থাবা বাবা নামে লিখতেন) জামায়াত-শিবির পরিচালিত ব্লগ ‘সোনার বাংলাদেশ ব্লগ’-এ একটি লেখা প্রকাশ করা হয়েছিল। ১১ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত ওই লেখার শিরোনাম ছিল, ‘শাহবাগের আন্দোলনের পিছনের মানুষগুলো’। স্পর্শের বাইরে ছদ্মনামে একজন লেখাটি লেখেন। সেখানে থাবা বাবাকে আক্রমণ করে নানাভাবে উসকানি দেওয়া হয়। রাজীব খুন হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই সোনার বাংলাদেশ ব্লগ থেকে লেখাটি মুছে ফেলা হয়েছে।
গতকাল গভীর রাতে মঞ্চ থেকে আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি দেওয়া হয়। এর অংশ হিসেবে আজ শনিবার কালো ব্যাজ ধারণ করা হবে। পাশাপাশি সোমবারের হরতাল প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়ে সবাইকে দৈনন্দিন কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। মঞ্চ থেকে জামায়াত-শিবিরের সোনার বাংলাদেশ ব্লগ বন্ধ এবং এর উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানানো হয় মঞ্চ থেকে। এ সময় আরও বলা হয়, আজ ব্লগার রাজীবের মৃতদেহ শাহবাগে আনা হবে এবং বাদ আসর এখানেই জানাজা অনুষ্ঠিত হবে।
আবদুল কাদের মোল্লার রায়ের প্রতিবাদে এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে। আর গতকাল ছিল সেই আন্দোলনের একাদশ দিন। টানা ১১ দিন এই আন্দোলন চলেছে এক মুহূর্তও বিরতি ছাড়া। নিরবচ্ছিন্ন, সুশৃঙ্খল এই আন্দোলনে কেঁপেছে পুরো দেশ। রাজধানীর সীমানা ছাড়িয়ে দেশের প্রতিটি প্রান্তে পৌঁছে গেছে সেই কম্পন।
জাগরণ সমাবেশে জনসমুদ্র: শাহবাগে গতকাল ছিল পূর্বনির্ধারিত জাগরণ সমাবেশ। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছাত্র-শিক্ষক, সাধারণ মানুষ, পেশাজীবী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শ্রমিক, দিনমজুরসহ সর্বস্তরের মানুষ এসেছিলেন শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে।
শুক্রবার বিকেল চারটায় লাখো মানুষের উপস্থিতিতে জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে শুরু হয় ‘জাগরণের সমাবেশ’। সমাবেশে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হকের ৪৪তম শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়।
সমাবেশ উপস্থাপনা করেন অঞ্জন রায় এবং সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দীন ইউসুফ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আনোয়ার হোসেন, অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত, লেখক-সাংবাদিক একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সভাপতি শাহরিয়ার কবির, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীসহ বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন সমাবেশে।
সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত সমাবেশে চলে বক্তব্য, সঙ্গে স্লোগান। অগ্নিকন্যা লাকী ও শাওনের স্লোগানে উজ্জীবিত ছিল পুরো গণজাগরণ চত্বর।
এ সময় মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে আগামীকাল রোববার সকাল ১০টায় দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতীয় সংগীত পরিবেশনা এবং জাতীয় পতাকা উত্তোলন করার কর্মসূচি দেওয়া হয়। পাশাপাশি শাহবাগে একটানা অবস্থানের বদলে প্রতিদিন বেলা তিনটা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত কর্মসূচি চলার ঘোষণা দেওয়া হলেও পরে সেটি বাতিল হয়।
আয়োজকেরা জানিয়েছিলেন, রাজধানীর দুটি প্রধান হাসপাতাল, যানজট—এসব কথা ভেবেই একটানা কর্মসূচি চালানোর অবস্থান বদলানো হয়েছে। তবে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ফাঁসি নিশ্চিত করা, জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ এবং জামায়াতের সব আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার মতো দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।
ভাষাসৈনিকেরাও ছিলেন: এই সমাবেশে যোগ দিতে এসেছিলেন বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সৈনিকেরাও। আহমেদ রফিক, কামাল লোহানী, শেখ জিয়াউল হক, জামিল আক্তার, বরুণ বিশ্বাস, রওশন জামিল, মনসুর মুসা, এস আর মাহমুদসহ ভাষাসৈনিকেরা বিকেলে হাজির হন সমাবেশে।
এসেছিলেন হুমায়ূন আহমেদের মা: এর আগে সকালে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে শাহবাগের গণজাগরণ চত্বরে নতুন প্রজন্মের সঙ্গে সংহতি জানাতে আসেন নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের মা আয়েশা ফয়েজ। শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে দুই সন্তান ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও আহসান হাবীব, দুই পুত্রবধূ ও নাতি-নাতনিদের নিয়ে শাহবাগে আসেন এই রত্নগর্ভা।
আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে কড়া রোদ মাথায় নিয়ে সপরিবারে সবার সঙ্গে বসে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিসংবলিত স্লোগানে কণ্ঠ মেলান হুমায়ূন পরিবার।
এ সময় জাফর ইকবাল বলেন, ‘দেশের প্রতিটি ক্রান্তিলগ্নে এ দেশের তরুণ সমাজ আগেও যেমন হাল ধরেছিল, স্বাধীনতার ৪০ বছর পরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে তারা প্রমাণ করেছে, দেশের সত্যিকার ভবিষ্যৎ তাদের হাতে।
বাংলাদেশের গণজাগরণ নিয়ে বিদেশি সংবাদমাধ্যমের বিভ্রান্তি ও বিকৃত প্রচারণা সম্পর্কে জাফর ইকবাল বলেন, ‘একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলো বিকৃতভাবে উপস্থাপন করেছিল। সে সময় আমরা যেভাবে স্বাধীনতা অর্জন করেছি, এবারও নতুন প্রজন্মের মুক্তিযুদ্ধে তরুণেরা সেভাবেই জয়ী হবে।’
১৯৭১ সালে পিরোজপুরে এসডিপিও হিসেবে কর্মরত থাকার সময় হুমায়ূন আহমেদের বাবা ফয়জুর রহমানকে পাকিস্তানি বাহিনী ধরে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করে।
জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি: গতকালের এই সমাবেশ থেকে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি জানান সব সংগঠনের ছাত্রনেতারা। এ ছাড়া জামায়াতের সব আর্থিক প্রতিষ্ঠান বয়কটেরও দাবি জানানো হয়। সমাবেশ শেষে ঘোষণায়ও একই আহ্বান জানানো হয়।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম বলেন, এই দেশের বিরোধিতা করেছিল জামায়াত। কাজেই তাদের এই দেশে রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। একই দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি এস এম শুভ, বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রীর সভাপতি বাপ্পাদিত্য বসু, বিপ্লবী ছাত্র সংহতির সভাপতি রাশিদুল হাসান, বাংলাদেশ ছাত্র সমিতির আহ্বায়ক জাহিদুর রহমান খান, বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রীর সভাপতি সালমান রহমান, জাসদ ছাত্রলীগ সভাপতি হোসেন আহমেদ তফসির ও বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রীর সভাপতি আবদুর রউফ।
ভারতীয় ছাত্রসংগঠনের সংহতি: একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে চলা আন্দোলনে সংহতি জানিয়েছে ভারতের ছাত্রসংগঠন ভারত ছাত্র ফেডারেশন। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির গণমাধ্যম বিভাগের দায়িত্বে থাকা ছাত্রমৈত্রীর সাবেক সভাপতি রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে জানান, শুক্রবার সকালে ভারত ছাত্র ফেডারেশন থেকে আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
এর আগে গতকাল শুক্রবার মহাসমাবেশ থেকে সাত ঘণ্টা অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। তবে এই ঘোষণা অনেকেই মানতে পারেননি। ব্লগসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে এ নিয়ে লেখালেখি শুরু হয়। শাহবাগে অবস্থানরতরাও প্রতিবাদ জানাতে থাকেন। তবে প্রতিবাদ তীব্র হয় রাত ১০টার পর। এ সময় খবর ছড়িয়ে পড়ে, আহমেদ রাজীব হায়দার নামের একজন ব্লগারের মৃতদেহ পাওয়া গেছে মিরপুরে। তিনি শাহবাগ আন্দোলনের একজন সক্রিয় সমর্থক ছিলেন। তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
ব্লগার হত্যার সংবাদটি ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ২০ থেকে ৩০ হাজার মানুষ আগে থেকেই শাহবাগ ছেড়ে না যাওয়ার জন্য অবস্থান করছিলেন। তাঁরা মিছিল বের করেন। গণজাগরণ মঞ্চ দখল করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়।
এ পর্যায়ে ১১টার দিকে মঞ্চে আসেন ব্লগার অ্যান্ড অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট নেটওয়ার্কের আহ্বায়ক ইমরান এইচ সরকার। তিনি এসে অবস্থান কর্মসূচি অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন।
মঞ্চ থেকে ১১টা ২৩ মিনিটে ব্লগার রাজীবের মৃত্যুতে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। মঞ্চ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়, জামায়াত-শিবির একজন ব্লগারকে খুন করেছে। এ ছাড়া তারা হরতাল ডাকার মতো দুঃসাহস দেখাচ্ছে। এ অবস্থায় কেবল মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের ফাঁসিই নয়, জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি জানানো হয়। এই দুই দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত কেউ ঘরে ফিরবেন না বলেও মঞ্চ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়।
জানা গেছে, ব্লগার রাজীবকে নিয়ে (ব্লগে তিনি থাবা বাবা নামে লিখতেন) জামায়াত-শিবির পরিচালিত ব্লগ ‘সোনার বাংলাদেশ ব্লগ’-এ একটি লেখা প্রকাশ করা হয়েছিল। ১১ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত ওই লেখার শিরোনাম ছিল, ‘শাহবাগের আন্দোলনের পিছনের মানুষগুলো’। স্পর্শের বাইরে ছদ্মনামে একজন লেখাটি লেখেন। সেখানে থাবা বাবাকে আক্রমণ করে নানাভাবে উসকানি দেওয়া হয়। রাজীব খুন হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই সোনার বাংলাদেশ ব্লগ থেকে লেখাটি মুছে ফেলা হয়েছে।
গতকাল গভীর রাতে মঞ্চ থেকে আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি দেওয়া হয়। এর অংশ হিসেবে আজ শনিবার কালো ব্যাজ ধারণ করা হবে। পাশাপাশি সোমবারের হরতাল প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়ে সবাইকে দৈনন্দিন কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। মঞ্চ থেকে জামায়াত-শিবিরের সোনার বাংলাদেশ ব্লগ বন্ধ এবং এর উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানানো হয় মঞ্চ থেকে। এ সময় আরও বলা হয়, আজ ব্লগার রাজীবের মৃতদেহ শাহবাগে আনা হবে এবং বাদ আসর এখানেই জানাজা অনুষ্ঠিত হবে।
আবদুল কাদের মোল্লার রায়ের প্রতিবাদে এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে। আর গতকাল ছিল সেই আন্দোলনের একাদশ দিন। টানা ১১ দিন এই আন্দোলন চলেছে এক মুহূর্তও বিরতি ছাড়া। নিরবচ্ছিন্ন, সুশৃঙ্খল এই আন্দোলনে কেঁপেছে পুরো দেশ। রাজধানীর সীমানা ছাড়িয়ে দেশের প্রতিটি প্রান্তে পৌঁছে গেছে সেই কম্পন।
জাগরণ সমাবেশে জনসমুদ্র: শাহবাগে গতকাল ছিল পূর্বনির্ধারিত জাগরণ সমাবেশ। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছাত্র-শিক্ষক, সাধারণ মানুষ, পেশাজীবী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শ্রমিক, দিনমজুরসহ সর্বস্তরের মানুষ এসেছিলেন শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে।
শুক্রবার বিকেল চারটায় লাখো মানুষের উপস্থিতিতে জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে শুরু হয় ‘জাগরণের সমাবেশ’। সমাবেশে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হকের ৪৪তম শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়।
সমাবেশ উপস্থাপনা করেন অঞ্জন রায় এবং সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দীন ইউসুফ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আনোয়ার হোসেন, অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত, লেখক-সাংবাদিক একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সভাপতি শাহরিয়ার কবির, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীসহ বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন সমাবেশে।
সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত সমাবেশে চলে বক্তব্য, সঙ্গে স্লোগান। অগ্নিকন্যা লাকী ও শাওনের স্লোগানে উজ্জীবিত ছিল পুরো গণজাগরণ চত্বর।
এ সময় মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে আগামীকাল রোববার সকাল ১০টায় দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতীয় সংগীত পরিবেশনা এবং জাতীয় পতাকা উত্তোলন করার কর্মসূচি দেওয়া হয়। পাশাপাশি শাহবাগে একটানা অবস্থানের বদলে প্রতিদিন বেলা তিনটা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত কর্মসূচি চলার ঘোষণা দেওয়া হলেও পরে সেটি বাতিল হয়।
আয়োজকেরা জানিয়েছিলেন, রাজধানীর দুটি প্রধান হাসপাতাল, যানজট—এসব কথা ভেবেই একটানা কর্মসূচি চালানোর অবস্থান বদলানো হয়েছে। তবে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ফাঁসি নিশ্চিত করা, জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ এবং জামায়াতের সব আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার মতো দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।
ভাষাসৈনিকেরাও ছিলেন: এই সমাবেশে যোগ দিতে এসেছিলেন বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সৈনিকেরাও। আহমেদ রফিক, কামাল লোহানী, শেখ জিয়াউল হক, জামিল আক্তার, বরুণ বিশ্বাস, রওশন জামিল, মনসুর মুসা, এস আর মাহমুদসহ ভাষাসৈনিকেরা বিকেলে হাজির হন সমাবেশে।
এসেছিলেন হুমায়ূন আহমেদের মা: এর আগে সকালে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে শাহবাগের গণজাগরণ চত্বরে নতুন প্রজন্মের সঙ্গে সংহতি জানাতে আসেন নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের মা আয়েশা ফয়েজ। শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে দুই সন্তান ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও আহসান হাবীব, দুই পুত্রবধূ ও নাতি-নাতনিদের নিয়ে শাহবাগে আসেন এই রত্নগর্ভা।
আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে কড়া রোদ মাথায় নিয়ে সপরিবারে সবার সঙ্গে বসে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিসংবলিত স্লোগানে কণ্ঠ মেলান হুমায়ূন পরিবার।
এ সময় জাফর ইকবাল বলেন, ‘দেশের প্রতিটি ক্রান্তিলগ্নে এ দেশের তরুণ সমাজ আগেও যেমন হাল ধরেছিল, স্বাধীনতার ৪০ বছর পরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে তারা প্রমাণ করেছে, দেশের সত্যিকার ভবিষ্যৎ তাদের হাতে।
বাংলাদেশের গণজাগরণ নিয়ে বিদেশি সংবাদমাধ্যমের বিভ্রান্তি ও বিকৃত প্রচারণা সম্পর্কে জাফর ইকবাল বলেন, ‘একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলো বিকৃতভাবে উপস্থাপন করেছিল। সে সময় আমরা যেভাবে স্বাধীনতা অর্জন করেছি, এবারও নতুন প্রজন্মের মুক্তিযুদ্ধে তরুণেরা সেভাবেই জয়ী হবে।’
১৯৭১ সালে পিরোজপুরে এসডিপিও হিসেবে কর্মরত থাকার সময় হুমায়ূন আহমেদের বাবা ফয়জুর রহমানকে পাকিস্তানি বাহিনী ধরে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করে।
জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি: গতকালের এই সমাবেশ থেকে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি জানান সব সংগঠনের ছাত্রনেতারা। এ ছাড়া জামায়াতের সব আর্থিক প্রতিষ্ঠান বয়কটেরও দাবি জানানো হয়। সমাবেশ শেষে ঘোষণায়ও একই আহ্বান জানানো হয়।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম বলেন, এই দেশের বিরোধিতা করেছিল জামায়াত। কাজেই তাদের এই দেশে রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। একই দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি এস এম শুভ, বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রীর সভাপতি বাপ্পাদিত্য বসু, বিপ্লবী ছাত্র সংহতির সভাপতি রাশিদুল হাসান, বাংলাদেশ ছাত্র সমিতির আহ্বায়ক জাহিদুর রহমান খান, বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রীর সভাপতি সালমান রহমান, জাসদ ছাত্রলীগ সভাপতি হোসেন আহমেদ তফসির ও বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রীর সভাপতি আবদুর রউফ।
ভারতীয় ছাত্রসংগঠনের সংহতি: একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে চলা আন্দোলনে সংহতি জানিয়েছে ভারতের ছাত্রসংগঠন ভারত ছাত্র ফেডারেশন। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির গণমাধ্যম বিভাগের দায়িত্বে থাকা ছাত্রমৈত্রীর সাবেক সভাপতি রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে জানান, শুক্রবার সকালে ভারত ছাত্র ফেডারেশন থেকে আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।